বীবর: প্রতিবেশ ধ্বংসের ঐতিহাসিক সাক্ষী

দু’পাশে ‍পাহাড় আর তার মাঝে বয়ে চলা বিশাল নদী। এর মাঝেই আমেরিকান বীবররা গড়ে তোলে তাদের আবাস। পাথর, গাছের ডালপালা, কাদা দিয়ে পরতে পরতে তৈরি ভেড়ি দ্বারা তারা নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করে – তৈরি করে ছোট্ট এক পুকুর। প্রায় ৪০ ফুট উঁচু এ ভেড়ি তৈরি করতে তাদের সময় লাগে প্রায় এক মাস। সিমেন্ট জাতীয় কোনো কিছু ছাড়াই শুধু হাতের কাজ দ্বারা পুরো ভূ-ভাগের দৃশ্য বদলে দেয়া, অত্যন্ত অবাক করা একটি ঘটনা। এদেরকে বলা চলে জল প্রকৌশলী। এ পুকুরের এক পাশেই তারা তাদের মূল আবাস গড়ে তোলে। বরফ ঢাকা সময়ে এ ঘর তাদের উষ্ণ থাকতে সাহায্য করে। শীত শেষে যখন বসন্ত আসে, তখন বরফ গলা শুরু হয়। পানির প্রচণ্ড প্রবাহে ভেঙে যায় বীবরের তৈরি শক্তিশালী ভেড়ি, ভাঙে ঘরও। শুরু হয় আবার বীবরের কর্মতৎপরতা। বিশাল বিশাল গাছ কাটা, ডালপালা জোগাড় করা, পাথর জোগাড় করা, নদীর নিচ থেকে কাদা তুলে আনা, এরপর ভেড়ি তৈরি, ঘর তৈরি।

উভচর প্রাণী বীবর। তাদের দেখা মেলে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ায় অবস্থিত বিভিন্ন বনাঞ্চলে। উদ্ভিদভোজী এ প্রাণী জলে চলতেই বেশি পটু। এদের হাতে থাকে পাঁচটি আঙুল, পা অনেকটা হাঁসের পায়ের মত, যা এদেরকে পানিতে চলতে সাহায্য করে। আর এদের লেজ কাজ করে নৌকার হালের মত।

বীবরের সাথে তাদের পরিপার্শ্বের সম্পর্ক অত্যন্ত বেশি। বীবরের তৈরি পুকুরের উপর নির্ভরশীলতা রয়েছে সেই অঞ্চলে বসবাসরত আরো অনেক প্রজাতির প্রাণীর।

ইতিহাসের পাতা থেকে:

বীবরের চামড়া দিয়ে তৈরি একটি হ্যাট

সময়টি ছিল সপ্তদশ শতাব্দী। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইংল্যান্ডে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল ইংল্যান্ড। উপনিবেশ স্থাপনকারীরা সেখানে পা রাখার অল্প কয়েকদিনের মাঝেই শুরু করে ফাঁদ পেতে বীবর ধরা। কেবল সপ্তদশ শতাব্দীতে বীবরের লোমশ চামড়া সংগ্রহ করার জন্য উত্তর আমেরিকায় এক কোটি থেকে দেড় কোটি বীবর হত্যা করা হয়েছিল! ১৬০০ সালের শেষ দিকে, নিউ ইংল্যান্ডের অধিকাংশ জায়গায় বীবর হয়ে ওঠে দুর্লভ। এ বীবরের কাঁচা চামড়া রপ্তানী হত ইংল্যান্ডে। বীবরের লোমশ চামড়া দিয়ে হ্যাট বা টুপি বানিয়ে তারা আবার তা রপ্তানী করতো বিভিন্ন উপনিবেশে। যেসব জায়গায় অভিজাত বণিকেরা বেশি বাস করতো, সে স্থানগুলোতেই এসব হ্যাট বেশি পরিমাণে রপ্তানী করা হত।

এ ঘটনার প্রেক্ষিতে ‘বিপন্ন পৃথিবী’ বইটিতে বলা হয়েছে,

“কোনো একটি অঞ্চলে একটি প্রধান প্রজাতি নির্বংশ করে ফেলা হলে বৃহত্তর প্রতিক্রিয়া কেমন হয়, সেটার নাটকীয় উদাহরণ বীবরের নির্বংশ হওয়ার মধ্যে যেভাবে পাওয়া যায়, সেটা নজিরবিহীন।”

বীবর আর তাদের বসতি নষ্ট হওয়ায় সে অঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত প্রতিবেশে বিপুল পরিবর্তন ঘটেছিল। এ পরিবর্তন আরো প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছিল অন্যান্য প্রজাতির ওপর। “বিপন্ন পৃথিবী” বইটিতে উঠে এসেছে এর বিবরণ:

  • বীবরদের বসবাসকৃত জলাশয়গুলোতে আসতো ব্ল্যাক ডাক, রিং-নেকড ডাক, হুডেড মার্গানসার ও গোল্ডেন আই পাখিরা। এরা আসতো ডিম পেড়ে বাচ্চা ফোটাতে। এই পাখিগুলোর আসা কমে গেল।
  • বীবররা বসতির চারপাশে ভেড়ি তৈরি করতো। বীবর না থাকায় এ ভেড়িও আর তৈরি হল না। জলাশয়গুলোতে পানি বেড়ে গেল। ফলে মাস্কর‍্যাট ও ভোঁদড়রা ডুবে যাওয়া এবং ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার সমস্যায় পড়লো।
  • মিংক, নেউলের খাবার হচ্ছে ব্যাঙ, সাপ, অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী। এই ব্যাঙ, সাপ, স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো থাকতো বীবরের চলাফেরার পথে। জলাশয়গুলোতে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় সেগুলো প্রথমে হল ডোবা, তারপরে জলাতীরের তৃণভূমি। ফলে ব্যাঙ, সাপ আর থাকলো না। মিংক, নেউলেরও খাবার হল বন্ধ।
  • বীবররা গাছের যেসব গোড়া ফেলে রেখে যেতো, সেখান থেকে গজিয়ে  উঠতো কচি পাতা আর ডগা। এই কচি পাতা খেতো শশক আর স্নোশু নামের খরগোশ। বীবরদের কেটে ফেলা গাছ রক্ষা করতো এদের।
  • এসব গাছের গুঁড়ি ছিল জংলি হাঁসদের বসন্তকালীন মিলনস্থল।
  • শশক আর জংলি হাঁস আবার ছিল রেড ফক্সের খাবার। ফলে রেড ফক্স নামের শেয়ালের খাবার গেল কমে।

এভাবেই বীবরের চামড়ার টুপি নিয়ে বাণিজ্য একটি সমগ্র প্রতিবেশ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছিল। বীবর বাণিজ্য যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা পেরিয়ে পশ্চিমে এগিয়ে চলছিল। আর সেই সাথে চলছিল প্রতিবেশ ব্যবস্থা ধ্বংসের এই প্রক্রিয়া।

তথ্যসূত্র:
১. জন বেলামি ফস্টার, বিপন্ন পৃথিবী, অনুবাদ: ফারুক চৌধুরী, পৃ: ৪০-৪১
২. https://www.nationalgeographic.com/animals/mammals/b/beaver/

ছবিসূত্র:
১. https://www.livescience.com/52460-beavers.html
২. https://www.livescience.com/10512-impact-beaver-dams-wider-thought.html

তথ্য সংগ্রহ ও উপস্থাপন:
সামিয়া ইসলাম। শিক্ষা সভার সদস্য।

লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ তারিখে শিক্ষা সভার ওয়েবসাইটে

Leave a comment

Design a site like this with WordPress.com
Get started